রাজু আলাউদ্দিন
ন্যানো কাব্যতত্ত্বের জনক কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। জন্ম ৬ মে ১৯৬৫ সালে শরিয়তপুরে। লেখাপড়া এবং বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরেই। কর্মজীবনের শুরু থেকেই সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত। মাঝখানে বছর দশেকের জন্যে প্রবাসী হয়েছিলেন ভিন্ন পেশার সূত্রে। এখন আবার ঢাকায়। ইংরেজি এবং স্পানঞল ভাষা থেকে বিস্তর অনুবাদের পাশাপাশি দেশি ও বিদেশি সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ছাব্বিশ।
তুমিই আমার আসমানী কিতাব
গোপনে তোমার কথা নিজেকে শোনাই বারবার
বিশ্বাসীর মতো আমি হৃদয়ের তজবী টিপে বলি: কী হবে ঈশ্বর দিয়ে ?
আমার ঈশ্বর নেই, নেই কোন মাতৃভূমি; শুধু তুমি আছ।
যদি থাকে ঈশ্বর তবে তুমি তারও চেয়ে বেশি,
যদি থাকে মাতৃভূমি তবে তুমি তারও চেয়ে বড়।
তোমার গভীর প্রেম সব কিছু তুচ্ছ করে কেবল তোমাকে
মহীয়ান করে তোলে আমার হৃদয়ে।
বন্ধুদের আড্ডায় তোমার প্রসঙ্গ এলে চুপচাপ কান পেতে শুনি–
যেন এক পরহেজগার পবিত্র আয়াত করছেন তেলাওয়াত পবিত্র কোরান শরীফের।
শবে কদরের চেয়ে আমি বেশি পুণ্যময় মনে করি তোমার কদর।
গভীর বিস্ময় নিয়ে যখন তোমাকে দেখি, মনে হয় তুমি এই পৃথিবীর নও,
ছিলে অন্য কোন লোকে হয়তো বা আল্লাহর পবিত্র কালাম রূপে
ছিলে তার জিহ্বার সিংহাসনে।
অকস্মাৎ তুমি এই জালেম শাসিত পৃথিবীর
আইয়ামে জাহেলিয়া যুগে এসে নাজেল হয়েছে
আমার মতোন এক দীনহীন আশেকের কোমল হৃদয়ে।
সুতরাং অন্য কোন গ্রন্থ নয় প্রিয়তমা তুমিই আমার একমাত্র আসমানী কিতাব।
আর আমি সে সুবাদে আরেক রাসুল।
নিখিলমঞ্জরি
মহামান্য সুরের স্রোতে শরীর ভেসে যায়
হৃদয় আমার ব্যস্ত তাই নিখিল পরিক্রমায়।
ভূমণ্ডলের বস্তুরা কি পাখায় নিল ভর?
এমন করে বাজাল সুর কোন সে যাদুকর?
শরীর ছুঁয়ে শরীর ছেনে হৃদয় বলাৎকার
করছে মহামান্য সুরের অখিল টংকার।
সময় হলো নৌকো আর আকাশ হলো পাল
আজকে তাতে কাটিয়ে দেব চিরদিনের কাল।
ক্যাসেট থেকে পড়ছে ঝরে নবম সিম্ফনি
আহা! পিতৃভূমি হতো যদি সুদূর জার্মানি!
আজকে নিখিল জগত আমার প্রাসাদ হয়ে ভাসে
বেদনা সব উৎস ভুলে মেতেছে উল্লাসে।
শ্রোতাকে আজ সৃষ্টি ছুঁয়ে করলো রূপান্তরি
আজকে আমি নতুন রাগ নিখিলমঞ্জরি।
তুমি আমার পৃথিবী
আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
মিগেল জানতে চায়: কোথায় তোমার দেশ?
বাংলাদেশ, শোনোনি কখনো?
না, কখনোই নয়।
কোথায় এ দেশ?
ভারতের কাছে।
ওহ্, তাই বলো।
আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
একদিন মারিয়ানা জানতে চেয়েছে,
কোথায় তোমার দেশ?
একই কথা বললাম তাকে।
লজ্জিত জানালো সে, হ্যাঁ,
ভারতের কথা আমি শুনেছি, যদিও
জানি না আসলে ঠিক কোথায় এ দেশ।
এশিয়ার কথা তুমি শোনোনি কখনো?
ওহ্, তাই বলো। বাংলাদেশ তবে সেই
এশিয়ার মাঝে!
ঠিক তাই।
যদি আমি কোনো দিন আরও দূরে চলে যাই
ধরা যাক, মঙ্গলগ্রহে।
তখন সেখানকার কেউ যদি জানতে চায়,
হেই, কোথায় তোমার দেশ?
আমি তো এসেছি দূর সবুজে আচ্ছাদিত
পৃথিবী নামক এক গোলাকার গ্রহভূমি থেকে।
সেখানে এশিয়া নামে বড় এক মহাদেশ আছে।
সেই মহাদেশে আছে ভারতভূমি।
আর সেই ভারতেরই কাছে এক সমুদ্র-তনয়া
হলো আমার স্বদেশ।
আমি যত দূরে যাই
আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।
বড় হতে হতে ক্রমে আমার নিকটে চলে আসে।
যখন নিকটে আসে, কানে কানে বলি তাকে:
যত ছোট মনে হয় তুমি তত ছোট নও, শোনো,
তুমি পৃথিবীর যেকোনো দেশের মতো বড়,
তুমি এই পৃথিবীরই মতো,
তুমি আমার পৃথিবী।
স্বপ্নের অনুবাদ
ঘুমের স্ট্রেচার যখন সন্তর্পণে আমাকে লোকান্তরের মর্গে ফেলে দিয়ে আসে, আমার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো তখন খরস্রোতা নদীর মতো কলকলিয়ে ওঠে। নিজস্ব মুদ্রায় তারা শিরদাঁড়ার নির্ভরে ফণা তুলে দাঁড়ায়, নিহিত নির্জনের ছায়ার পাৎলুনে ঢাকা তাদের শরীর, বাৎসল্যের চূড়ান্ত ছুঁয়ে আছে তাদের প্রত্যেকের নিকানো শরীর-সংসার। আমারই ঔরসে জন্ম তবু যেন এরা কেউ আমার সন্তান নয়; এই নষ্ট, ভ্রষ্ট আর তুচ্ছতার কর্দমে আটকে পড়া আমাকে ছাড়িয়ে ওরা বহু দূর চলে যায়। এক সময় নক্ষত্রের ক্ষুদ্রাকারে ঝুলে থাকে কালোত্তর আকাশের গভীর খিলানে, যেন উদবাস্তুর স্বদেশহীনতার অভিমান এদের প্রত্যেকের রক্তে প্রবাহিত, প্রগতি ও রাষ্ট্রের যাবতীয় সুফল থেকে বঞ্চিতের মতো সময়ের অনেক গভীরের তলানির নিঃসঙ্গ নিস্বন বুক নিয়ে ওরা ভীষণ আলাদা হয়ে আছে।
আমি প্রতিদিন ঘুমের গভীর আলিঙ্গনে মরে যাই। আর ওরা জেগে ওঠে, যেন ওরা আমার শৈশবের খেলার প্রতিপক্ষ দল। আমি ফিনিক্স পাখির মতো অশান্তির তীব্র আগুনে আত্মাহুতি দেই; ওরা আমার ছাই থেকে জন্ম নিয়ে আমার জন্মের সবচেয়ে নির্মল রূপান্তর চুরি করে তস্করের মতো চলে যায়, দূরে।
ওরা অভিশপ্ত টাইরেসিয়াস, কেন না ওরা আমার মধ্য দিয়ে দেখেছিল সভ্যতার সবচেয়ে নির্মম নিষিদ্ধ দৃশ্য : মানুষের রক্তে স্নানরতা অভিজাত নগ্ন অ্যাথিনীকে। নাকি অর্থনীতিকে? ওরা সেই উপহাস ও শ্লেষবিদ্ধ টাইরেসিয়াস, কেননা ওরা বলে দিয়েছিলো ইডিপাস কীভাবে মাতৃভূমিকে ক্রমাগত সঙ্গমে কলুষিত করে যাচ্ছে দিনের পর দিন।
আমি যখন এইসব কবিতার ঝনাৎকারে মৃত্যুর খুচরো আলিঙ্গন ভেঙে জেগে উঠি; ওরা ততক্ষণে ঊর্ধ্বশ্বাসে উধাও পালায়, যেন অবাঞ্চিত কেউ; যেন টিলো এক্সপ্রেস খেলতে গিয়ে ভুল করে মৈথুন-মগ্ন কোন দম্পতির ঘরের জানলায় চোখ পড়তেই দ্রুত-সটকে-পড়া এক বালক।
এইভাবে আমার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো প্রতিদিন নাগালের বাইরে থেকে যায়; আমি আকাঙ্ক্ষা উসকে দিয়ে পৃথিবীর যাবতীয় আড়াল করে ধীবরের মগ্নতায় একা বসে থাকি; কিন্তু ওরা কেউ পূর্ণাঙ্গ ও পরিশুদ্ধ হয়ে আসে না কখনো, শুধু ওদের নিঃসৃত বর্ণালীর রক্তিম-সরণ আমাকে অযথাই মাঝে মধ্যে বিচলিত করে,
….. বিস্রস্ত করে রাখে দিনের পর দিন।
অসংখ্য মৃত্যু নিয়ে আমার জন্ম হয়েছিল
অসংখ্য মৃত্যু নিয়ে আমার জন্ম হয়েছিল।
মৃত্যু ছিল আমার ঘনিষ্ঠ সহোদর।
আমার রক্তস্রোত নিয়ে তারা ছুটে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।
তারা এতটাই কাছাকাছি ছিল, তারা এত বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল
মনে হতো প্রেমিকের মতো তারা পেছন থেকে কাঁধের বাদিক দিয়ে
আমার কপোলে চুমু খেতে চায়।
মৃত্যুগুলো প্রায় পোষ্য বেড়ালের মতো আমার কাঁথার নিচে শীত রাত্রে কাটিয়েছে পরম আরামে।
মৃত্যু ক্রমে, ধীরে ধীরে আমার প্রেমিকা হয়ে উঠেছিল এই ছোট্ট একাকী জীবনে,
অবসরে শুনাতো সে ঠাকুরের গান:
তুহুঁ মম শ্যাম সমান।
আমি বুঝতে পারিনি, মড়কের মতো অসংখ্য মৃত্যু আমার সাথে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল এই পৃথিবীতে।
এইসব মৃত্যুগুলো এত বেশি বলীয়ান ছিল, এইসব মৃত্যুগুলো দলে দলে এত বেশি বড় হয়ে গেছে; আমি ক্রমে হয়েছি একাকী।
এসব মৃত্যুর চাপে আমার জীবন ক্রমে ছোট হয়ে গেছে।
আমার মৃত্যুগুলো নিয়ে কিছুদিন আগে বিশাল বিশাল সব প্রদর্শনী হয়ে গেছে ইরাক, তুরস্ক ও কাবুলের বড় বড় গ্যালারিগুলোয়। এগুলোর উদ্বোধন করেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর তার নাতিদীর্ঘ মুখবন্ধ লিখেছিল জাতিসংঘের মহান সচিব।
বেশ কিছু মৃত্যু আমি গোপনে বিক্রি করে দিয়েছি সাংসদ ও মন্ত্রীদের কাছে।
থানায় থানায় আমি কিছু মৃত্যু বিক্রি করেছি চড়া দামে।
আরও কিছু মৃত্যু আমি ছড়িয়ে দিয়েছি আমাদের ব্যস্ত সড়কে।
এইসব মৃত্যুগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখে প্রতিদিন।
আমার মৃত্যুগুলো জ্যামিতিক হারে ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে দেশে ও বিদেশে।
আমার মৃত্যুগুলো ঘুমে ও নিদ্রায় আমাকে ক্লান্ত করে শুধু।
সুজলা সুফলা মৃত্যুতে ভরে গেছে আমার হৃদয়।