হোমেন বরগোহাঞি

0
834

দীপায়ন দত্ত রায়: সদ্য প্রয়াত হয়েছেন প্রখ্যাত অসমীয়া সাহিত্যের জ্যোতিপুরুষ হোমেন বরগোহাঞি। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার এবং সাংবাদিক এই মানুষটি সারাজীবনে পেয়েছেন অজস্র সন্মান, যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ১৯৭৮ সালে তাঁর বিখ্যার উপন্যাস ‘পিতাপুত্র (১৯৭৫)-এর জন্য সাহিত্য অকাদেমি প্রাপ্তি।

ওঁর কর্মব্যস্ত জীবনের অনেকটাই কেটেছে সাংবাদিকতায়। আমৃত্যু অসম সাহিত্য সভার সভাপতির পদ অলংকৃত করার পাশাপাশি সামলেছেন একাধিক পত্রপত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত জনপ্রিয় দৈনিক ‘নিয়োমিয়ো বার্তা’-র মুখ্য সম্পাদক। এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক ‘নাগরিক’-এর। বাংলার ‘আজকাল’ পত্রিকার সঙ্গেও কর্মসূত্রে কিছুদিন ছিল প্রত্যক্ষ সম্পর্ক।

ষোলো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ পড়ে মনস্থির করেন, পরিণত বয়সে তিনি নিজেও উপন্যাস লিখবেন। পরের ছয় দশকে বরগোহাঞি লিখেছেন মোট ১১টি উপন্যাস। ‘সওদর পুতেকে নাও মেলি যায়'(সওদাগরের পুত্র নৌকা বেয়ে যায়), ‘অস্তরাগ’, ‘পিতাপুত্র’, ‘তিমির তীর্থ’, ‘সুবালা’, ‘এদিনের ডায়েরি’, ‘মৎস্যগন্ধা’ প্রভৃতি কালজয়ী উপন্যাসের স্রষ্টা হোমেন বরগোহাঞি তাঁর আত্মজীবনী ‘অনুসন্ধান’-এ লিখেছিলেন, ‘আমার সমসাময়িক অনেক লেখকেরই সাহিত্যিক হয়ে ওঠার বাসনার তলায় চাপা পড়ে গেছে যে বাস্তবমুখিতা, তাকেই জাগিয়ে তুলতে চেয়েছি আমি। আমি কোনও সাহিত্যিক নই, আমি সাধারণ লেখক।’ লেখক আর সাহিত্যিকের এই অনন্য পৃথকীকরণ সম্বল ছিল বরগোহাঞির শিল্পীজীবনের। আজীবন নীরবতাযাপী, প্রচারবিমুখ প্রাজ্ঞ এই লেখক তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন অনাবিষ্কৃত অপাংক্তেয় এক গ্রাম্য ভারতের কথা, যে ভারত দারিদ্র্য, অশিক্ষা, নারীনির্যাতন, বর্ণাশ্রমের অন্ধকারে আচ্ছন্ন পরিত্যক্ত এক ভূখণ্ড, যাকে স্বাধীনতার আলো আজও স্পর্শ করতে পারেনি। ‘মোর হৃদয় এখন কুরুক্ষেত্র’ নামক আত্মজৈবনিক প্রবন্ধ-সংকলনের এক জায়গায় লিখেছিলেন, ‘আজও আমার দেশের সবাই স্বাধীন নয়, কেউ কেউ স্বাধীন’।

ছাত্রজীবন থেকেই রমা রঁল্যার ভক্ত বরগোহাঞি পশ্চিমী দর্শন ও সাহিত্য থেকে পেয়েছিলেন স্বদেশের মানুষের প্রতি নির্মোহ অথচ সহানুভূতিশীল থাকার বিনম্র দীক্ষা। শুধু তাই নয়, কৈশোরে ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থানে আহত ও সন্ত্রস্ত বরগোহাঞি অসমীয়া ভাষায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথের ‘ন্যাশনালিজম্’। জীবনের শেষ লগ্নে এসেও ফ্যাসিবাদের প্রতি একইরকম বীতশ্রদ্ধ এই লেখক দেশে ‘ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের প্রতিবাদে’ ফিরিয়ে দেন তাঁর সাহিত্য অকাদেমি পদক।

বরগোহাঞি-র সবচেয়ে বেশি আলোচিত উপন্যাস ‘পিতাপুত্র’। এই উপন্যাসে রয়েছে কৈবর্ত জনজাতির মানুষ-অধ্যুষিত অসমের প্রত্যন্ত মহঘুলি গ্রামে স্বার্থপর জমিদার শিবনাথ ফুকানের উত্থান থেকে পতনের এক বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ। খুব সহজেই লেখক দুটি প্রজন্মের মতান্তরকে স্থান দিয়েছেন সাবলীল গল্পবয়নে। প্রাক্-স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা-উত্তর সময়পর্বে ভারতবর্ষের জমিদারতন্ত্রের পতনের পটভূমিতে কিভাবে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষের জীবনও আমূল বদলে যেতে পারে, ‘পিতাপুত্র’ তারই একটি বিশ্বস্ত দলিল।

কৈশোরে একবার একটা ছোটগল্প পড়ে কয়েক রাত ঘুমাতে পারেননি হোমেন। গল্পটা ছিল ‘দ্য হাঙ্গার আর্টিস্ট’ এবং গল্পকার ফ্রাঞ্জ কাফকা। সেই ছিল কাফকার সঙ্গে ছোট্ট হোমেনের প্রথম সাক্ষাৎ। এরপরে কটন কলেজে পড়ুয়া থাকাকালীন পড়েন ‘দ্য কাসল’ আর ‘এ গ্রেট ওয়াল অব্ চায়না’। বহুবছর পরে, কাফকার উপন্যাসের নায়ক-ই আদিত্য বড়ুয়া হয়ে ফিরে আসবে বরগোহাঞি-র উপন্যাস ‘এদিনের ডায়েরি’-তে। এই উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র আদিত্য অবতীর্ণ হতে দেখি অন্তহীন এক অন্বেষণে। বারবার তাকে বলতে শোনা যাবে, ‘আমি খুঁজছি। জীবনের মানে খুঁজছি’।

অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে ‘সুবালা’, ‘অস্তরাগ’ ও ‘মৎস্যগন্ধা’-ও উল্লেখের দাবি রাখে। ‘সুবালা’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতের এক পরিত্যক্ত অংশে অভুক্ত মানুষের দিনগুজরানের ছবি আঁকে। ‘অস্তরাগ’-এও পাই দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করা দিলীপ ও তার বার্ধক্যপীড়িত বাবার ক্লিন্ন জীবনের মর্মন্তুদ রোজনামচা। অন্যদিকে, বরগোহাঞি-র সবচেয়ে নারীবাদী উপাখ্যান ‘মৎস্যগন্ধা’ পুরাণাশ্রয়ী মিথের সুচারু বিনির্মাণ। এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র জেলে-সম্প্রদায়ের মেয়ে মেনকার বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব, তার সংযম এবং অদম্য জেদ পাঠকের শ্রদ্ধার উদ্রেক করে।

ছোটগল্পকার হিসেবেও বরগোহাঞি-র অবদান কম নয়। ওঁর লেখা শতাধিক ছোটগল্পের মধ্যে বিশেষ সমাদৃত ‘আবরণ আর ঝড়’, ‘নৈরাশ্য’, ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘জনসেবক’। ‘নৈরাশ্য’ এক বৃদ্ধার নিঃসঙ্গ দিনযাপনের গল্প, যিনি বিজনে বসে দিনমান ডুবে থাকেন আতত অতীতচারিতায়। ‘প্রত্যাবর্তন’ এক মানুষের ঘরে ফিরে আসার গল্প। তবে, এই ‘ঘর’ আক্ষরিক নয়, প্রতীকী। অহেতুক আত্ম-অসন্তোষের ব্যধিকে পরাস্ত করে এক প্রৌঢ়ের জীবনের মূলস্রোতে ফিরে আসার ইতিবাচক উদাহরণ ‘প্রত্যাবর্তন’। ‘জনসেবক’ গল্পে এসেছে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকের প্রসঙ্গ, যা বরগোহাঞি-র লেখায় অন্যতম বহুলব্যবহৃত মোটিফ। এই গল্পের অসৎ রাজনীতিবিদ্ রত্ন গোস্বামীকে দেখে আমাদের মনে পড়বে ‘পিতাপুত্র’-র কেশব মণ্ডল, রেবা মহাজনকে। ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার হিসেবে বরগোহাঞি-র খ্যাতি খানিকটা আড়াল করেছে তাঁর কবিসত্তাকে। ‘তক্ষক’, ‘স্মৃতি’, ‘বিকল্প’-এর মতো অসামান্য কিছু কবিতাও লিখেছেন হোমেন বরগোহাঞি।

মাঝবয়সে এই অসমীয়া লেখকের সখ্য তৈরি হয় প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক গ্রাহাম গ্রীনের সঙ্গে। ‘ব্রাইটন রক’ পড়ে মুগ্ধতার কথা ব্যক্তিগতভাবে জানিয়েওছিলেন গ্রীনকে। গ্রাহাম গ্রীনের মতোই মনে করতেন, ‘লেখালেখি একটা সাধনা। তাই রোজ নিয়ম করে লেখার রেওয়াজে বসতেই হবে’। বরগোহাঞি জীবনের শেষদিনগুলোতে মারির শিকার হওয়ার আগে অবধি বজায় রেখেছিলেন এই রেওয়াজ, যা যে-কোনও নবীন লেখকের জন্যই শিক্ষণীয়। যখন নভেল, গল্প, কবিতা আসেনি, তখন লিখে গিয়েছেন একের পর এক অনবদ্য প্রবন্ধ, একাধিক আত্মকথা।

‘আনন্দ আরু বেদনার সন্ধানাত’ (আনন্দ আর বেদনার সন্ধানে) বইয়ের একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমাদের সমস্ত জীবন তো আসলে অন্তহীন এক দুঃখ-সুখের যৌথস্রোতের অন্বেষণ। আমরা যখন থাকব না, তখন তো এই স্রোতটুকুই থেকে যাবে’। ঠিকই বলেছেন বরগোহাঞি। তিনি শরীরীভাবে আমাদের ছেড়ে গেছেন এই আগেই। তবে তাঁর জীবনব্যাপী অন্বেষণ রেখে গেলেন আমাদের জন্য। কিসের সেই অন্বেষণ, তা তো আগেই বলেছেন তিনি — ‘মৃত্যুর মেঘে ঢেকে থাকা অনন্ত জীবনের'(‘মোর তোকাবাহির পোরা’/’আমার ডায়েরির ছেঁড়া পাতা থেকে’)।