গাগি আর সুপারম্যান :: গুলজার

0
386

অনুবাদ: সৌমিত্র চৌধুরী

সুপারম্যানের ভিডিও ক্যাসেট আর কমিক্স বইয়ে ভরে উঠেছে আমার ঘর। এগুলো তো আগে বাচ্চাদের ঘরেই থাকত। কিন্তু একটু একটু করে এগুলো আমার বইয়ের তাক দখল করে নিচ্ছিল। একটা বই বের করতে যাবো অমনি একটা সুপারম্যান নিচে গড়িয়ে পড়ে। খানিক পরে আমিই বইয়ের পেছনে ওগুলো গুঁজে দিই। দু-তিন বার এমন হল যে অমিকে বললাম, এগুলো টান মেরে জঞ্জালের দোকানে বিক্রি করে দাও।

‘মাম্মি, নো’, বুঝতে পারি না কোথা থেকে বুচকি ঠিক হাজির হয়ে যায়। তখনও ওর হাতে ধরা থাকে সুপারম্যানের একটা বই। ইংরেজিতে আমাকে বলে, ‘পাপা, হাউ ক্যান ইউ? সুপারম্যান ইস সুপারম্যান। বরং তোমার কয়েকটা বই বিক্রি করে দাও। সুপারম্যানেরও তো জায়গা দরকার’।
অমি ওর কথা শুনে হেসে ফেলল। ঘর থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলল, ‘এখনও তো ভিডিও আসা বাকি আছে। এদিকে ওর ঘর সুপারম্যানে ঠাসা’।
-কিন্তু এ সব কোথা থেকে আসছে?
-গাগি নিয়ে আসে।

গাগি আর আমার মেয়ে এক বয়সি। গলায় গলায় বন্ধু। কিন্তু আলাদা স্কুলে পড়ে। ওর যা বয়স তার অর্ধেকের কম বয়স থেকে আমাদের কাছে মানুষ। বাকি অর্ধেক কাটিয়েছে নিজের বাবা-মায়ের কাছে। বিকাশ দেশাই আর অরুনা রাজের কন্যা ও। ওরা একসাথে কাটিয়েছে মাত্র এগার বছর।
দিন-রাত বাচ্চাদের একটাই কাজ ছিল। টিভিতে সুপারম্যান দেখা আর সুপারম্যান কমিক্স পড়া। মানা করলে তক্ষনি পরীক্ষার মার্ক্শিট দেখিয়ে দেবে। ঐ তিন চারটে বাচ্চা, সবাই ক্লাশে দারুণ রেসাল্ট করে। শুধু পড়াশোনাতেই নয়। অন্য কাজেও।

একদিন প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল আমার। বাচ্চাদের জোর ধমক দিয়েছিলাম। বকা খেয়ে গাগি বলল, ‘কাকু, সুপারম্যান হল ভগবান। ভগবানের মতই সব কিছু করতে পারে’। বড় অদ্ভুত লেগেছিল গাগির জবাব।
যখন ওর ন’বছর বয়স, জানা গেল ক্যান্সারে আক্রান্ত ও। হাড়ের ক্যানসার। পগ্‌গি আর বুচকু ওর বন্ধু। পগ্‌গি বসু বাবুর মেয়ে। ফিল্মের লোক আমরা। সিনেমা বানাই। সে কারণেই ঘন ঘন সাক্ষাত হয় আমাদের। তাই আমাদের বাচ্চাদেরও এক ঘরে জমায়েত হওয়া খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আমার স্ত্রী অন্য জায়গায় থাকতেন। তাই আমার ফাঁকা ফ্ল্যাটেই বেশি আড্ডা বসতো। বাচ্চারাও স্বাধীন ভাবে থাকতে পারত।

একবার ব্যাঙ্গালোরে আমরা সবাই একসাথে ছিলাম। বিকাশ সাঁতার কাটতে ভালোবাসতো। দিনের বেশির ভাগ সময়টাই সুইমিং পুলে কাটাতো। ছোটদের সাঁতার শেখাত ও। জলে বাচ্চাদের সাথে খেলতে ভালোবাসতো। বিকাশ ছিল বেশ মোটাসোটা। একবার গাগি ওকে বলেছিল, ‘বাবা তুমি এত মোটা। তবু জলে ডুবে যাও না কেন’?
‘আরে, জানিস না জলের অনেক ক্ষমতা। বড় বড় জাহাজকে বুকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়’।
‘কিন্তু আমার ঘড়ি তো ডুবে গেছিল!’

বিকাশ জুতসই জবাব দিতে না পেরে অরুণার দিকে তাকিয়ে ছিল। অরুণার হাসিবাঁধ মানছিল না। বহুক্ষণ ধরে হেসেই যাচ্ছিল ও। বিকাশের মুখে রাগ আর বিরক্তি লক্ষ করে আমি তখন নিজের ঘরে ফিরে এসেছিলাম। বিকাশ যখন গাগিকে নিয়ে ফিরল, দেখলাম মেয়েটা খোঁড়াচ্ছে।

রোগের প্রথম আক্রমণ শুরু হয়েছিল গাগির পায়ে। হাঁটতে অসুবিধা তাই গাগির পায়ের চিকিৎসাই প্রথমে শুরু হল। অনেক জুতো বদল হল। তৈরিও করাতে হল বহু ধরনের জুতো। কিন্তু মেয়েটার পায়ের ব্যাথা সাড়ল না। কত্থক নাচ শিখবার খুব ইচ্ছে ছিল ওর। সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু গাড়ির দিকে চলতে গিয়ে কিম্বা সিঁড়ি থেকে নামবার সময় মুখে বোল ফুটত — তেরে কেটে তা থৈ থৈ…তেরে কেটে তা থৈ থৈ… ।
ওর পরিবারে গান বাজনারও চল ছিল। নামকরা গায়ক বসন্ত দেশাই ওর ছোট দাদু।

গাগির পায়ের ব্যাথা খুব বেড়ে গেল। স্কুলের পড়াশুনায় পিছিয়ে পড়তে লাগলো ও। কত্থক নাচের বাহানা দিত। তাই অরুনা বাড়িতেই নাচ শেখার ব্যবস্থা করেছিল। শিক্ষক এসে শেখাতেন। কিন্তু তবুও নাচ ভালো করতে পারছিল না গাগি। না পারার কারণ হিসাবে পায়ে বাঁধা ভারী ঘুঙুরের অজুহাত দিতে লাগলো।
প্রথমবার ডাক্তার অধিকারীই সন্দেহ করলেন যে ওর রোগ অ্যাঙ্কেল কিম্বা পায়ের কোথাও নয়। আছে শরীরের হাড়ে। এক্স-রে তে কিছু ধরা পড়ল না। অন্য পরীক্ষা শুরু হল। বিকাশ ওর কাকা বসন্ত দেশায়ের বাড়িতে থাকা শুরু করল। যশলোক হাসপাতালের সামনেই ছিল সেই বাড়ি। পেডর রোডে।

ডাক্তার অধিকারী কিছু একটা সন্দেহ করেছিলেন। দু-তিন মাস ধরে উনি কেবলই নিজের ধারনা যাচাই করে চলেছিলেন। কিন্তু একদিন উনি রোগের নির্ভুল রিপোর্ট গাগির বাবা-মায়ের সামনে মেলে ধরলেন। বাইরের ঘরে গাগি বসেছিল। অরুন আর বিকাশ ডাক্তারের ঘরে। ওদের মুখে কোন কথা নেই। গাগির ক্যানসার সনাক্ত হয়েছিল।

ডাক্তারের সামনে থেকে উঠে যাবার সময় অরুণা আর বিকাশ প্রতিজ্ঞা করেছিল, কোন দিন তারা গাগির সামনে চোখের জল ফেলবে না। একান্তে কে কতটা চোখের জল ফেলত, জানি না। তবে সত্যি কথা, বাকি দু’বছর প্রবল যন্ত্রণা বুকে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ওরা লড়াই চালিয়ে গেছে। সে সময় গাগির বয়স ছিল নয়।

পুরানো বন্ধু, নতুন সাথী, কাকা, কাকিমা, খেলা, ভিডিও, বাঁদর খেলা, ভালুক নাচ — কিছুই আসতে বাকি থাকেনি গাগির ঘরে। গাগিকে কিছু ভাববার সুযোগই দেওয়া হয় নি। বিকাশ আর অরুনা হাসপাতালের গুরুগম্ভীর পরিবেশ বাড়িতে ঢুকতেই দেয় নি। ওদের দু’জনের সাহসের প্রশংসা করতে হয়। সেই সময়ে গাগি অন্তাক্ষরি খেলায় এক্সপার্ট হয়ে উঠেছিল। যখন চিকিৎসার অন্য কোন উপায় কাজে লাগছিল না, অপারেশন করানোর কথা ভাবা হচ্ছিল। অনেক ভাবনা চিন্তার পর অপারেশন করাতে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়া হল গাগিকে। গাগি তখন জেনে ফেলেছিল যে ওর ক্যানসার হয়েছে।
‘কিন্তু বাবা, আমার পায়ে কেন হল’?

‘বেটা, বোন ক্যানসার ওটা। পায়ের হাড়ে হয়েছে। অপারেশন করলে ঠিক হয়ে যাবে। রোগটা শরীরে ছড়িয়ে পড়বার আগে ওটা কেটে বের করে দেবে’।
আমেরিকায় কয়েক মাস চিকিৎসা চলল। কেমোথেরাপির প্রভাবে গাগির মাথার সব চুল উঠে গেল। মাথায় হাত দিলেই চমকে উঠত ও। চোখে মুখে ভয় নিয়ে মা-বাবার দিকে তাকাত। ওরা হাসি মুখে বলত, “টাক! আরে দু’মাসের মধ্যেই আবার চুল উঠে যাবে’।‘আরে আমার তো টাক ভালোই লাগে। এটাই নোতুন স্টাইল’।
‘আরে ক’দিনেই চুল এসে যাবে’।

আমার মনে হত, গাগির বাবা-মার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তাদের মেয়ে সেরে উঠবে। ডাক্তাররাও মেয়ের পায়ে প্লাস্টার করে ফেরত পাঠাবার পর সেরকমই আশ্বাস দিয়েছিলেন।
আমেরিকা থেকে ফিরে আসবার কয়েক দিন পর গাগির পা থেকে দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। খুব কষ্ট পাচ্ছিল মেয়েটা। ডাক্তার অধিকারির জায়গায় এবার অন্য ডাক্তার ডাকা হল। উনি দেখেই পায়ের প্লাস্টার খুলিয়ে দিলেন। পায়ের বহু জায়গায় ঘা হয়ে গেছিল। সব ক’জন ডাক্তারবলছিলেন, ‘ক্যানসার তো নেই’।

কিন্তু কেউই সঠিক চিকিৎসা করতে পারছিলেন না। ডাক্তার বাবুরা ঘন ঘন ওষুধ বদলাতে লাগলেন। তিন মাসের মাথায়, ক্যানসার আবার ফিরে আসতে পারে এই ভয়ে, গাগির ডান পা কেটে ফেলা হল। বৈদ্যুতিক চুল্লিতে নিয়ে গিয়ে সেই পা জ্বালিয়ে দেওয়া হল। মৃত মানুষ সৎকারের যাবতীয় নিয়ম মেনে।
গাগির দৃষ্টি উপর থেকে নীচে নেমে এলে ও খুব মৃদু গলায় বলল, ‘বাবা, ভগবান আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন? আমি তো কোন অন্যায় করিনি’।

সেই দিনগুলোতে অরুণা কৃষ্ণের মূর্তি ঘরে এনে রেখেছিল। মূর্তির সামনে ধূপ জ্বালাত, দিন রাত প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখত। কৃচ্ছসাধন করত। মাছ মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। কখনও গাগি কাবাব বা টিক্কা খেতে চাইলে আনিয়ে দিত। ডাক্তারের অনুমতি নিয়েই। জিজ্ঞেস করতেই ডাক্তাররা অনুমতি দিয়েছিলেন।
একদিন যখন নোতুন ডাক্তার বাড়ি এল, গাগি জিজ্ঞেস করল ‘আবার ডাক্তার বদল করেছ বাবা’?
‘হাঁ বেটা। আগের ডাক্তারকে দিয়ে কাজ হচ্ছিল না’।

‘এই ভগবানকে দিয়েও তো কোন কাজ হচ্ছে না। বাবা, আর কোন ভগবান নেই’?
অরুণার জবাব তো কখনও এমন হয় না। কেন জানি ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘ওরা সুপারম্যানেরই মত। ওদের বাহাদুরি শুধু লেখা থাকে বইয়ের পাতায়।

 

লেখক পরিচিতি: গুলজার সাহেবের পরিচয় দেওয়া অনাবশ্যক। গুলজার তাঁর ছদ্ম নাম। আসল নাম সম্পুরণ সিং কালরা। চিত্র পরিচালক, গীতকার, কবি, সুলেখক গুলজার (জন্ম ১৯৩৪পাঞ্জাবের, অধুনা পাকিস্তান, ঝিলম জেলায়) সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ সাহিত্য অ্যাকেডেমি পান (২০০২)। শিল্পকলায় অসামান্য অবদানের জন্য পদ্মবিভূষপুরষ্কারে সম্মানিত হন (২০০৪)। সিনেমার ক্ষেত্রে পান রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার–গ্র্যামি এওয়ার্ড, অস্কার এওয়ার্ডও তিনি পেয়েছেন। সিনেমার চিত্রনাট্য, গান, অসংখ্য কবিতা ও গল্প লিখেছেন তিনি। উর্দু মিশ্রিত হিন্দিতেই (উর্দু-হিন্দুস্থানি) তিনি বেশী লিখেছেন। এছাড়াও পাঞ্জাবী, ব্রজভাষা, হরিয়ানভি, মাড়োয়ারি ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। বর্তমান গল্পটি, ‘পিছলে পন্নে’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত, ‘গাগি আউর সুপারম্যান’।