ভষ্মমাখা আমাদের আশ্রয়
১
ঘর বলতে সামান্য এই সন্তানহীন বৃক্ষের মতো পায়ের পাতার কাছে জমে থাকা শূন্যতাটুকু। শেষ রাত্রির গূঢ় অনুশোচনার মতো আজ স্তবকের পর স্তবক ভেঙে রক্ত গড়িয়ে গেল। বিষও উঠে এল কিছু। সান্ধ্য ভ্রমণের বোধহীন চিহ্নগুলি খুলে রেখেছে এক একটি স্পর্শের মতো অজানা সংলাপ। আমার জামা ছিঁড়ে গিয়ে বুকের হাড় ও তাতে পেঁচিয়ে ওঠা উদ্ভিদ দেখে আঁৎকে উঠল স্পন্দনহীন সময়…
জলের সমীপে উড়ে এল ছাই, কুঠুরির ভিতর সম্পর্ক পোড়া ভষ্মমাখা আমাদের আশ্রয়!
২
আস্তাবলের খড়ের গাদায় আমরা নিস্পৃহ শুয়ে আছি খেলনামানুষ। গুঁড়ি গুঁড়ি পোকা ও ঝুরো স্বপ্নমায়া আমাদের আকাশ ঢেকে রাখে। রাত্রির শেষ স্তবকখানি আরও নির্জলা উপোসের তৃষ্ণার মতো হয়ে উঠল। তুমি তার ভিতর কামনার মিহি আলোয় আরও বিচ্ছেদপ্রিয় গান গেয়ে ওঠো। সেই গানের নিঃস্তব্ধ মায়ার ভিতর আমি তোমার ঊরু ছুঁয়ে শপথ করি হিমপ্রবাহের কাছে, আমাদের সন্তানের মৃতদেহ কয়েকশো মাইল দূরের নগ্ন সরাইখানায় ফেলে দেব…
দেবতার যে সকল ফুল খুব প্রিয় অন্তিম সঙ্গমের প্রাক্কালে তারই ভিতর লুকিয়ে ফেলব শোকক্লান্ত গৃহ!
৩
রোদ এসে পড়েছে নাভিমূলে লেগে থাকা শেষ সূর্যাস্তের কাছে। নদীগহ্বরে ভেসে আছে প্রণয়নী রাত্রি। তোমার না ফোটা আলোড়নগুলি রাস্তা পেরিয়ে শস্যখামারের দিকে চলে গেছে। ভোরের পাখি ডানা ঝাপটায় খুব, যার বুকে লেগে গেছে ভুল করে ছুটে আসা তীরের ফলা। গাছের পাতাদের চোখ ঘুমে নেমে আছে। আলপথে সাপ, খোলসে জড়ানো ছোবল। মাঠের হাহাকার বুকে নিয়ে জেগে উঠি শব্দখোড় যুবক। তুমি তার চিবুকে আঙুল ছুঁইয়ে দিলে পুরনো জামাখানি খুলে প্রেমিকের মতো নতজানু হয়ে ধুয়ে দেবে ঈশ্বরের পায়ের পাতা। তুমি যে অভিসন্ধি নিয়ে আজ এই নদীর বুকে লুকিয়ে পড়েছ তার দিকে আশ্চর্যের নেশা নিয়ে তাকিয়ে আছে মহাকাল…
বহু পুরোনো স্মৃতিচিহ্নের হাঁ-এর মতো সমূহ বিপর্যয় ভেঙে স্পর্শে স্পর্শে জাগিয়ে তোলো এই স্বপ্নাতীত সকাল!
৪
জড়িয়ে রেখেছি শব্দপ্রবাহের মতো শূন্য হাওয়া। কাঁপা কাঁপা নৈঃশব্দ্যের ঢেউ এসে লাগে শরীরের পুকুরঘাটে। বোধ উড়ে যায়, উড়ে যায় সহস্র বছর ধরে বুকের অন্ধকারে বাসা বেঁধে থাকা কুঁড়ি কুঁড়ি পতঙ্গ। যাদের নিজস্ব দেহের আলোয় নিজেদেরই সংসার পুড়ে গেল। বাসা ভেঙে গড়িয়ে গেল নবজাতকের ডিম। তাই গাছে গাছে আজ ফুটে আছে কান্নাফুল। রঙের ভিতর রং লেগে আলোছায়া মুছে গেছে। কত রাতের পর আজ জ্যোৎস্না নেমেছে এই প্রান্তিক ঘরের অভিশাপ মাখা কোণটিতে, যেখানে তোমাকে স্পর্শ করার মুহূর্তেই আমাদের উপর ভেঙে পড়ল ঘর, তার উপর আকাশ, তার উপর পৃথিবী, তারও উপর সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড…
আমি আজ সেই অন্তিম শয্যার কাছে ফিরে এসে পুরনো জন্মের স্মৃতিচিহ্নগুলি অকারণে খুঁজে চলি উপশমের ভুল বিশ্বাসে!