গুচ্ছ কবিতা: অরিত্র সান্যাল

0
389

এখানে অন্যমনস্কতা নিয়ে কথা বলা হচ্ছে

[একটা পুরোনো জানালা। আর তাকে খোলা হয় না।
এর ভিতরে     আগলে রাখা অন্ধকার
কেউ –         তার অর্থ।
যেমন
বহুদিন অব্দি রেখে দিলে সাদা পাতাও অর্থে ভরে যায়।]

আমার ভিতর

এক ছোপ অন্ধকার এসে পড়েছে মেঝেতে। আরও অন্য ঋতু অন্যতর বেলা অব্দি বিছিয়ে আছে অবসান। অবসানের মধ্যে দানীভর্তি ফুল। পাতাগুলি আমায় বললো, যে কাতরতা সাদার ভিতর থেকে সুগন্ধ তুলে আনে – তা তোমার গো সবটাই তোমার

আমার বুকের মধ্যে ঢুলে আসে প্রকাণ্ড এক চোখ, যখন অকল্পনীয় বেদনার মর্মবোধ নিয়ে দরজা ঠোকরাই

শূন্যতা কীসের তৃষ্ণা – আমি খুঁজে বেড়াই পোড়ো বাড়িতে। ইদানিং এক অতৃপ্ত আত্মা আমায় চেঁচিয়ে বলছে – ঘর থেকে সুদূরে বেরিয়ে যা –
দূষণ সীমানার বাইরে ভৌ ভৌ কুকুর ডেকে ওঠে। সহস্র বৃংহন দিয়ে জেগে ওঠে ট্রাকের আলো। নিবারণে ঢেউ তুলে অশান্ত হয়ে যায় মাছ

আমার মধ্যে একটি আঁচর ছটফট করে। আমার মধ্যে সকিছুর একটি অন্য অবসান টানা আছে। আমি বাইরেটা দেখি
আমার লেখার
ভিতর

সমুদ্রের শব্দ

ভিতরে অনেক সমুদ্রের শব্দ। অনেক। অনেক। আজ সকাল থেকে সবকিছুর সঙ্গে সবকিছুর ঠোকাঠুকি লাগছে। এক পাতা বনিবনা- না হওয়া কাটাকুটি নিয়ে খেতে বসেছে একটা দানো। তাকে জলের বহুতলে রাখা হয়েছে, আর সে কখনোই দু:খরেখা পেরিয়ে আসতে পারে না। আমি সারাদিন দেখে যাচ্ছি জীবন কীভাবে ছাপিয়ে যায়। দেওয়ালে ছায়া পড়ছে এমন যে, সচল হয়ে উঠছে গুহাচিত্র। জানলা আর দরজার মুখ ফিরিয়ে আছে এমন যে, ঘরের ভিতর থেকেই হারিয়ে যাচ্ছি। বাড়ি সকাল সকাল ফেটে পড়ছে অন্ধকারে। একটা হৃৎপিণ্ড এক একবার ছোট হয়ে যাচ্ছে, আবার বড়। আমি ভাবতাম যেকোনো ধাতব আওয়াজই আসলে সংসারের আদিম কথা। দীর্ঘক্ষণ ধরে সময় বয়ে যাচ্ছে, ও কই? ও কই?
আমাদের একটু একটু করে কেউ খেয়ে নিচ্ছে।
 ঘর ছোট হয়ে যাচ্ছে

দেওয়ালগুলির খুব খিদে পেয়েছে।
ভেতরে এক পাগল ক্ষেপিয়ে তাদের কাছে ডেকে আনছে পরস্পরের।
ঘর ছোট হয়ে যাচ্ছে। পাগল বড় হয়ে যাচ্ছে।

এই সবকিছুর বাইরে থাকার একটি লোক চাই লোক চাই লোক চাই
যে ফ্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করবে – সমুদ্র আর কতদূর?

বাইরে দেখা

এখানে কিছু করা দরকার

টিভি চলতেই থমকে থমকে যাচ্ছে ছবি।
রঙ নিভে –
এই সময়টুকুতে পৃথিবী কি বিশ্রাম নেয়?

আমাদের ঘরে একটা খারাপ হয়ে যাওয়া দমের পুতুলও আছে –
যতক্ষণ না সবকিছু স্বাভাবিক হয়
অন্যমনস্কতা নিয়ে কথা বলা যেতে পারে

যে কোনও যন্ত্রই অচল হলে জানালার বাইরে তাকায়

আলস্যের রঙ সবুজ, কারণ গাছের সারি এখন আরামসে দুলছে হাওয়ায়,
মঠের দিকে যেতে ট্রাফিক পেরিয়ে ভেড়ার পাল ধোঁওয়ার মতো ডাকছে।

প্ল্যাকার্ড রেখে কয়েকজন ঘুমিয়ে পড়েছে রাস্তার ধারে। বাসি খবরের
কাগজে পৃথিবীর বসন্ত দাগ ঢেকে গেল।
এই সমস্ত কিছু থেকে কি চোখ ফেরানো যায় কখনই?
চোখ স্থির, অথচ দেখছি না কিছুই –
কেন না তারও বাইরের দিকে কেউ তাকায়, খালি তাকিয়ে থাকে

বাহির এমনি করে শেষ হয়ে যায়
কেউ উঁকি দিল জানালায়

কাহিনি

একটি অসীম ক্ষমতা আমাদের ঘর আলো করে রাখে-
হাওয়ায় পাতা এলোমেলো
পর্দায় রঙিন ছবি

সরলতাকে তুমি যতটুকু ভাবো- তা কি আর তত সামান্য?
সমস্ত পুরোনো পরিচ্ছেদ উল্টোদিকে কাৎ হয়ে থাকে
উত্তরের জানালায়
পাম গাছ
ধোঁওয়ার রেখা
সবকিছু কেমন একায় ঠেস দিয়ে আছে

কত কী-ই না হতে পারে
কোথায় যে কীসের এক খুব সৈনিক লুকিয়ে আছে –
চারদিক এখন ধুন্ধুমার শান্ত
ছাদে রাখা বাটি থেকে বৃষ্টি খেতে খেতে একটা পাখি
ম্লান হয়ে গেল

কী খুলে গিয়েছে যে সবকিছু এত ছড়িয়ে অবান্তর হয়ে পড়ছে?

কাহিনি কোথায় থাকে?
বাইরেটা পিছিয়ে এসে জানালা হয়ে
আস্তে আস্তে ঢুকে আসে একটি নিরবিচ্ছিন্ন শুয়ে থাকা মানুষে

বিস্মরণের মতো হালকা

পুরু বিস্মরণ পড়ে আছে সবকিছুর ওপর।
তুমি দেখতে পাও – কেন সবকিছু এত হাল্কা?
পর্দা ঠেলে আমি দৃশ্যে ঢুকলাম ঈষৎ ঝুঁকে থাকা কবি হয়ে।

ধুলোভর্তি একটি জীবনের আর কোনদিকে দেখবো?
নিজেকে অর্থগভীরতাহীন একটি উঁচু বাড়ির মতো হালকা লাগে।
ছুটন্ত দৃশ্যের মতো হাল্কা। সরোবরের ধারে বসে থাকা দুজন
এত হাল্কা যে প্রেমিক-প্রেমিকা নয়…
আমার কিন্তু ভাল লাগে পাশাপাশি এই অস্তিত্বের আরামে থাকা।
তুমি যদৃচ্ছের মতো ভারী শব্দটি নিয়ে কেন হাসো?
সবকিছুর মধ্যে ইদানীং একটি ফাটল, লক্ষ্য করি, সর্বদা অন্যদিকে তাকায়
যেদিকে সমস্ত আবর্তনের পরিশ্রম ঝরে পড়ছে শূন্যে – কোনো কারণ নেই কোথাও