প্রণয় ফুকনের (Pranay Phukan) জন্ম ১৯৬২ সালে, শিবসাগরের দিখৌমুখ অঞ্চলে একটি নদী তীরবর্তী গ্রামে। শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী পিতা-মাতার সন্তান। চিকিৎসা বিজ্ঞানের কৃতি ছাত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞানে গবেষণার জন্য আর্ন্তজাতিক স্তরে স্বীকৃত এবং পুরস্কৃত। ডাঃ ফুকন বর্তমানে অসম মেডিকেল কলেজের গাইনোকলজি বিভাগে অধ্যাপনারত। পেশাগত ব্যস্ততার মধ্যেও গত দুই দশকের ভেতরে কয়েকটি কবিতা সংকলন এবং উপন্যাস প্রকাশিত।কবি বিদেশি কবিতার অনুবাদ এবং কবিতা সম্পর্কিত আলোচনায় নিরত।কবিতা পাঠের জন্য সাহিত্য আকাদেমি কর্তৃক আয়োজিত দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত। কবিপত্নী ডাঃ রীতা অসম মেডিকেল কলেজের নিঅ’নেটলজি বিভাগের অধ্যাপিকা এবং দুই পুত্র দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। কবির শখ সঙ্গীত,ভ্রমণ এবং নিঃসঙ্গতা। গ্রন্থসমূহ ১)মোরে শপথ তেলিফোন ন করিবা (কবিতা), ২)মোক কিয় দূষিছ হিরন্ময়ী (কবিতা), ৩)অলপ ভালপোয়া অলপ যন্ত্রণা (কবিতা), ৪)মহাভারত, প্রেম আরু যন্ত্রণার পদাবলী (দীর্ঘ কবিতা), ৫)এখন্তেক নিজর স’তে (কবিতা), ৬)আবেলির অতিথি (উপন্যাস) ইত্যাদি।
মূল অসমিয়া থেকে অনুবাদ: বাসুদেব দাস
নিঃস্রোতা নদীর কথা
(এটা কোনো নারীর কাহিনি নয়)
যে নদীর কোনো স্রোত নেই,
যে নদী হারিয়ে ফেলেছে অকালে
বুকের গভীরতা,
সেই নিঃস্রোতা নদীর বুকে সম্ভব নয়
সাগর সন্ধানী যাত্রা।
নিঃস্রোতা নদীর কোনো নারীবাদ নেই
নৃত্য চাঞ্চল্য নেই
কোনো কল্লোল নেই
রূপকথা নেই
নেই কোনো নন্দনতত্ত্ব।
নিঃস্রোতা নদীর বুকে আসে না
শ্রাবণের প্লাবন
শস্যশালিনী হয়ে ওঠে না দু পারের মাঠ।
গড়ে ওঠে না কোনো বাণিজ্য শহর।
পারে গড়ে ওঠে না কোনো উদ্যমী সভ্যতা।
নিঃস্রোতা নদীর বুক কেবল বালিময়।
দুপারে থাকে না কোনো কাব্যিক গোধূলি,
থাকে না শীতল বাতাসের লাবণ্য।
নিঃস্রোতা নদীর বুকে
সৃষ্টি সম্ভব নয় উত্তাল তরঙ্গ।
কেন এই নির্লিপ্ততা নিঃস্রোতা নদীর,
কেন এই নির্বোধ শূন্যতা !
কোথাও নষ্টমতি কেউ
তৈ্রি করেনি তো বুকে
এক দুর্লঙ্ঘ বাঁধ অলক্ষিতে ?
আর হঠাৎ যদি বাঁধটা
ভেঙে পড়ে একদিন অজান্তে !
(সমস্ত কবিরা বলে নদীগুলি নারীর মতো !)
অন্য এক জীবন
মলয়া পিসির কুড়ি বছরের জন্মদিনে
সদ্য এম এ পাশ বিকাশদা
গোপনে একটা শাড়ি দিয়েছিল।
খুব দামি নয়, কটন শাড়ি।
সেই সময় মোবাইল ছিল না।
পার্লে মর্টনের আশায়
আমিই ছিলাম বিশ্বস্ত পিয়ন।
বিকাশদা এখন দূর বিদেশে
অবিবাহিত।
কোথাও কিছুর নাকি প্রফেসর।
মলয়া পিসির ছেলে-বৌমা নিয়ে
এখানে সুখের সংসার।
সেদিন পঞ্চান্ন বছরের জন্মদিনে
মলয়া পিসির গায়ে সেই শাড়ি!
জিজ্ঞেস করলাম আকারে–ইঙ্গিতে
চোখের ইশারায় হ্যাঁ বললেন।
কাছে এসে কানে কানে বললেন
প্রতিটি জন্মদিনে পরেন।
যদি আমি নির্বাচনে দাঁড়াই
যদি আমি নির্বাচনের দাঁড়াই
নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা আছে।
আমার সপক্ষে আছে অনেক ভোটার,
নিরুপায় নদীগুলি, ধ্বংসপ্রাপ্ত অরণ্য গুলি,
চৌদ্দ কোটি বেকারের ভেঙ্গে পড়া স্বপ্ন গুলি,
কর্মহীন প্রব্রজক শ্রমিকের নৈরাশ্য গুলি,
বন্যায় ভাসিয়ে নেওয়া মাঠের দীর্ঘশ্বাসগুলি,
ধারাল কাঁচি এবং লাঙ্গলগুলি।
যেহেতু আমার সাত পুরুষে কোনো শিকারি ছিল না
জঙ্গলের জীব-জন্তু পাখি গুলি আমার পক্ষে।
আমার পক্ষে আছে
ভূপেন হাজারিকা–বব ডিলানের গানগুলি,
রবীন্দ্রনাথ-নেরুদা-নবকান্তের কবিতাগুলি,
তুর্গেনিভ, টলস্টয়, হোমেন বরগোহাঞির বইগুলি
পড়ি বলে জানি তরুণ কবির
সপ্রতিভ কবিতা গুলি আমার পক্ষে।
মন বোঝা কঠিন শহর নগর গুলির।
কিন্তু ছয় লাখ পঞ্চাশ হাজার গ্রাম আমার পক্ষে।
এন্টিলিয়ার নগণ্য ভোট গুলি চাই না,
সমস্ত ধারাবী আছে আমার সঙ্গে।
বিরানব্বইয়ের ছয় ডিসেম্বর থেকেই
আমার মনোমালিন্য আর্য রামের সঙ্গে।
বিপরীতে দ্রাবিড় রাবণের সমস্ত বংশধর
আমার পক্ষে আছে।
কোনো রঙ চাইনি,লাল-গেরুয়া-সবুজ।
নিজে এসে আমার পক্ষে যোগ দিয়েছে
আকাশের অনন্ত নীলিমা।
আমার নির্বাচনী ইস্তাহার?
সকলের গায়ে যাতে সূর্যের আলো সমানভাবে পড়ে
তারই অঙ্গীকার।
এভাবেই সাত পাঁচ গুণে
একশো শতাংশ নিশ্চিত আমি
আগামী নির্বাচনে
বিপুল জনমতে জয়ী হব বলে।
সম্রাট নীরো বেহালা বাজাচ্ছে
অনেকদিন লিখিনি কবিতা।
‘আম আদমি’হয়ে সুখে ছিলাম
হালকা হালকা বলে মনে হচ্ছিল মন।
অন্ধ বোবার মতো সময় কাটছিল।
কে আর কবিতা লিখে
বাঘের মুখে পড়ে আজকাল!
অবশেষে পারলাম না।।
সন্ত্রাস চলছে চারপাশে।
কবিতা লেখার ভূতটা
পুনরায় গায়ে এসে ভর করল।
দুর্দিন দেখলে বুকগুলি কেঁপে উঠে।
দেশ জ্বলছে,জ্বলছে প্রদেশ।
হত্যা ধর্ষণ লুণ্ঠন চলছে।
লাখ লাখ মানুষ গৃহহারা হচ্ছে।
পেটের ক্ষুধায় মানুষ মরছে।
সম্রাট নীরো বেহালা বাজাচ্ছে।
সম্রাট নীরো বেহালা বাজাচ্ছে
আপন মনে।
বেহালার সুরে সুরে দেশ জ্বলছে,
পিঁপড়ের মতো মানুষ মরছে।
সম্রাট নীরো বেহালা বাজাচ্ছে
হ্যাঁ হুজুর সভাসদরা
বাঃবাঃ দিচ্ছে।
আমার মতো আম জনতা চিৎকার করে মরছে।
দেশ চলছে দেশ চলবে
এভাবেই যুগে যুগে।
সেই কবিতাটি লিখতে পারলে
সেই কবিতাটি লিখতে পারলে
যা গর্জন করে উঠবে সমুদ্রের মতো,
যা তুফান আনবে সমগ্র দেশে,
তছনছ করে ফেলবে গ্রাম-শহর-নগর।
যাকে বেআইনি বলে ঘোষণা করা হবে
নিষিদ্ধ হবে সমস্ত শব্দ-বর্ণ-ছন্দ।
লিখতে পারলে সেই কবিতাটি
যার ছন্দে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী মিছিলে
উত্তাল হয়ে উঠবে রাজপথ।
দেশে ঘোষিত হবে জরুরি অবস্থা,
ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হবে মন্ত্রিসভা,
সষ্টম হয়ে উঠবে পুলিশ সেনা বাহিনী।
কোণে কোণে চেকপোস্ট তালাশি চলবে,
হাত তুলে বের করে আনবে নিরীহ যুবক
যেখানে সেখানে এনকাউন্টার হবে,
রেল বাস চলাচল বন্ধ হবে,
চাকরি যাবে প্রৌঢ় মুখ্য সচিবের,
কম্পিত কন্ঠে সারা রাত
ফোনে ব্যস্ত থাকবে পুলিশের সঞ্চালকপ্রধান।
সেই কবিতাটা লিখতে পারলে
যা উৎকণ্ঠিত করে রাখবে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে,
অধীর করে তুলবে আমার প্রেয়সীকে
নিরাপত্তা নিশ্চিত একটি নিবিড় চুম্বনের জন্য,
বন্ধ হয়ে যাওয়া কলেজ ইউনিভার্সিটি থেকে
বাড়ি ফিরে আসা সন্তান
লিখতে উৎসাহিত হবে প্রতিবাদের কবিতা।
কে লিখবে সেই কবিতা?
যে কবিতা সৃষ্টি করা কালো তুফানের শেষে
একটা নতুন সূর্যোদয় হবে,
শান্ত সমাহিত হয়ে উঠবে আমার উৎপীড়িত উপত্যকা
আমি আমৃত্যু প্রতীক্ষারত সেই কবিতার জন্য।