রথযাত্রায় হাতের স্পর্শ: অরুণাভ রাহারায়

0
360

রথযাত্রা উৎসবের সঙ্গে আমার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। জগন্নাথদেব মাসির বাড়ি থেকে রথে চেপে আসবেন। দড়ি টেনে তাকে স্বাগত জানাতে হবে। আমার ছোটবেলা মানেই আলিপুরদুয়ার। তখনকার দিনে আজকের মতো ছোট ছোট রথের চল ছিল না। এখন দেখি ছোট রথ নিয়ে বাচ্চারা বাড়ির সামনের রাস্তায় খেলছে। ব্যাপারটা বড় হয়ে দেখে বিস্মিত হয়েছি। অথচ ছোটবেলায় আলিপুরদুয়ারে দেখতাম প্রকাণ্ড রথ– দূর থেকে একসঙ্গে বহু মানুষ টেনে আনছেন। রথের মেলা বসত দুর্গাবাড়িতে। প্রতিবার বাবার হাত ধরে সেই মেলায় যেতাম। কত কত স্মৃতি! আট থেকে আশি সবাই আসত মফস্বলের রথের মেলায়। আর লটকা ফল রথের দিনে খাওয়া চাই-ই চাই। বাবা কিনে দিত একগুচ্ছ লটকা। যারা দেখেছেন তারা জানেন মূলত উত্তরবঙ্গে পাওয়া যায় এই ফল। অপূর্ব স্বাদ। আমাদের ছোটবেলার সঙ্গে অনেকটা জড়িয়ে এই ফল। সন্ধে হলে মেলায় ভাজা হত আড়াই প্যাঁচের জিলিপি। দোকান ঘিরে কিশোরদের হইচই। অনেক বছর দূরত্ব থেকে সেইসব বিকেলগুলো দেখি আর নস্টালজিয়ায় ডুব দিই…।

মেলায় গিয়ে বাবার কাছে বায়না ধরে যে কোনও খেলনা কেনা চাই। একেই কি রথ দেখা কলা বেচা বলে? বাবা অফিস থেকে ফিরে এসে বলত– চল রথের মেলায় যাই। রথের মেলা নিয়ে আমার তো আগ্রহ ছিলই সঙ্গে বাবারও উৎসাহের খামতি ছিল না। মফস্বলের মেলাগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এখন আর বক্রিবাড়িতে ঝুলন মেলা দেখি না। বহু যুগ পর অষ্টমীর স্নানের মেলায় গিয়ে দেখি আগের মতো ভিড় নেই। তাই শৈশবের রথের মেলা থেকে গিয়েছে একেবারেই মনের কোণে।

একটু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালটে গেল রথ উৎসব। তখন সাইকেলে বন্ধুরা মিলে যেতাম খোলটায়। অনেক বেশি স্বাধীন। দুর্গাবাড়ি চত্বর জুড়ে ঘুরে ঘুরে দেখতাম মেলা। অপার আনন্দ হত। ৭ দিন বাদে আবার উলটো রথের মেলা বসত। হরেকরকম মালপত্তর। সে মেলার চেহারাই ছিল আলাদা। তিন-চার বছর আগে বিরাটিতে রথের মেলায় দেখি ধুমধাম উৎসব। মাইকে গান বাজছে। শ্বেতপাথর বাঁধানো চত্বরে জনসমাগম। কোনও ধুলোবালি নেই! শৈশবের গন্ধটিও হারিয়ে গিয়েছে। কেবল মুছে যায়নি তারুণ্যের স্মৃতি! একবার রথের মেলায় দূর থেকে লক্ষ্য করলাম টিউশনি পড়ার ব্যাচের ভালো লাগা মেয়েটি বাড়ির সামনে মায়ের সঙ্গে রথের দড়ি টানছে। বিকেলে কনে দেখা আলোয় তার গোলাপি পোশাক ভীষণ উজ্জ্বল। তাদের বাড়ি পেরিয়ে রথটি এগিয়ে এল বাবুপাড়া রেল গুমটির দিকে। তারপর আমিও, ঠিক মেয়েটি যেখানে ধরেছিল, দড়ি ধরে টানলাম। এভাবেই তার হাতের স্পর্শ পেলাম আমি। সেই স্পর্শ, টের পাই, আজও আমার হাতে লেগে আছে!