বিশ শতকের ছটি মোঙ্গোলীয় কবিতা

0
333

অনুবাদ: অমরেন্দ্র চক্রবর্তী

১॥
রাজকীয় সূর্য পৃথিবীকে আশীর্বাদ করে
ও. ডাশবালবার (১৯৫৭-১৯৯৯)

সত্যিই, বন্ধুরা, এই সুন্দর ব্রহ্মাণ্ডের সূর্য
দৃশ্য জগতের ওপর
অবিনশ্বর ফুলে ভরে যায় না?
সত্যি বন্ধুরা, মেঘের ফাঁকে সূর্যের
ঝিলিকের মতো
আমাদের সাদামাটা জীবন চিরকাল টিকে থাকবে ভেবে
আমরা কি নিজেদের ঠকাই না?
সত্যিই, বন্ধুরা, তরুণ বয়সে শক্তসমর্থ চেহারায় যা শেখা হয়নি
তা বৃদ্ধ বয়সে, দুর্বল দেহে শেখা কি সত্যিই কঠিন নয় ?

মোঙ্গোলীয় গান। এর কথা ও সুর মোঙ্গোলদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। মোঙ্গোলিয়ায় আজও এ গান গাওয়া হয়।

২॥
শরৎ
অয়ুনৎসেতেৎসেগ ৎসেন্দ-আয়ুশ (১৯৮৮)

চাঁদ হরিণের মতো জল খেতে ঝুঁকে পড়েছে।
পাহাড়গুলো তৃষার্ত ঘোড়াদের মতো ঢকঢক করে হাওয়া গিলছে
উপত্যকাগুলো কুয়াশার কম্বলে মুখ ঢাকে
ঝোপগুলো পুরুষ হরিণদের ডাকছে, ঠিক যেন একটা সুর।
মাছ গিলে নেয় নদীর কলরোল,
সুন্দরী রমনীদের উচ্চহাসির মতো পুরনো হয়ে যায়।
নিঃশব্দ স্তেপভূমি পড়ে থেকে থেকে পতাকার মতো জীর্ণ।
উজ্জ্বল হরিণেরা আগুনের মতো ঝলকায়।
মেঘের দলা থেকে বৃষ্টি পড়ছে যেন ঘোড়ার চোখের জল,
মন্দিরের ছাদ থেকে ফোঁটাগুলো ঝরছে মানুষের অশ্রুর মতো।
বেহালার সুরের মতো পাখির ঝাঁক আকাশ পেরিয়ে যায়।
গাছের পাতাগুলো খসে পড়ছে মাটির ওপর গিটারবাজনার মতো।
ওহ্। এই শরৎ…

পশুপালকের ছেলে এই কবি মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কবিতা লেখা শুরু করেছে।
২০১১ সালে সাহিত্যের স্নাতক। ‘কুয়াশার’ মধ্যে দিয়ে’, ‘বিষাদগীতি’ ‘দূরের ওপর আলো’ তাঁর এপর্যন্ত তিনটি কবিতাগ্রন্থ লিখেছেন। মোঙ্গোলিয়ান রাইটার্স ইউনিয়ন পুরস্কৃত, পেশা মোঙ্গোলিয়ার জাতীয় রেডিওর সাংবাদিক।

৩॥
পৃথিবীর পথ
গোম্বোজভ মেন্দ-উয়ো (১৯৫২-)

অশ্ব পৃষ্ঠে আমরা যাত্রা শুরু করলাম, ভোরের খুদে পাখিরাও চলেছে আমাদের সঙ্গে
সন্ধ্যায় দোয়েলের সঙ্গে আমরা আমাদের বাঁধা গণ্ডির মধ্যে ফিরে এলাম।
শত শত বৎসর চামড়ার কাজ করে, কাঠ কেটে, তলোয়ার ঢালাই করে
মোমবাতি নিভে গিয়ে আবার জ্বলে ওঠার পর মানুষ ইতিহাস গড়বে।
নদীর জল এই ঘোলাটে, এই আবার স্বচ্ছ।
নদীর ধারে জ্বালানি কাঠ নিভেও আবার জ্বলে ওঠে
দুনিয়ার যত পাথরের চাঁই
বছর বছর গড়াতে গড়াতে থিতু হতে হতে ক্ষয়ে যায়।
মানুষের পায়ে চলার পথ দৈনন্দিন ধুলোয় ঢাকা পড়ে।
সকালের জয়জয়াকারের মধ্যে অশ্বপৃষ্ঠে আমাদের যাত্রা।
সন্ধ্যার ক্লান্তির মধ্যে আমাদের বাঁধা গণ্ডিতে আমরা ফিরে আসি।
শত শত বৎসর আমরা তলোয়ারে শান দিয়ে, কবরের গর্ত খুঁড়ে, মোম জ্বালিয়ে,
তারপর সকাল হলে আমরা ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়বো শেখার তাগিদে।
আমাদের কেউ কেউ শহর বানাবে। অন্যরা রাগে তা জ্বালিয়ে দেবে।
এই দুজন তাদের সেনাধ্যক্ষদের মুখোমুখি যুদ্ধ বাঁধাবে
তারপর পড়ে থাকবে শুধু গল্পকথা।
দুনিয়া এভাবেই চলে, তলোয়ার ঢালাইয়ের মতো,
ভরপেটে দুর্ভিক্ষ মনে করার মতো।

মোঙ্গোলিয়ায় যাযাবর বংশে ১৯৫২ সালে জন্ম। গোম্বোজভ মেন্দ-উয়োর লেখায় মোঙ্গোলিয়ার যাযাবর পশুচারকদেরজীবন ও তাদের সংস্কৃতি ও সে বিষয়ে তাদের জ্ঞান ধারণার ছায়া দেখা যায়। তাঁর শৈলী ও বিষয় ভাবনায় তিনি ‘গেগিনতেন’ (পূত পবিত্র একজনা) উপন্যাসের জন্য ২০১২ সালে উলানবাতারে বর্ষ সেরা উপন্যাসের পুরস্কার ‘সোনালি পালক’ পান। তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস শিলিন বোগদ্’ (পবিত্র পাহাড়)। সিভিতেল্লা রানিয়ের ফাউন্ডেশনের ফেলোশিপ পেয়ে তিনি ইতালির সিভিতেল্লা দুর্গে ছ-সপ্তাহ ছিলেন। হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে বিশ্ব কবি সম্মেলনে সর্বোচ্চ কবিতা-পুরস্কার লোনালি মুকুট-সহ পোয়েট লরিয়েট ও আরও বহু পুরস্কারে ভূষিত মেন্দ-উয়োর সাহিত্য জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ২০১৫ সালে। মোঙ্গোলিয়ার সর্বোচ্চ সম্মান ‘অর্ডার অব চেঙ্গিস খান’ লাভ করেন। লেখক হিসেবে একমাত্র তিনিই এই সম্মানের অধিকারী। এই সম্মান ঘোষণা করেন দেশের রাষ্ট্রপতি।

৪॥
তুমিই শরৎ
সাইনজারগেল নাশিন (১৯৯১-)

আমার হৃদয়ের বর্ষপঞ্জি মেলে দিলাম
তোমার সঙ্গে দেখা হবার সময়টা আতসকাচের নীচে ফেলে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে
মনের সামান্য দ্বিধা নজরে এলো।
অচেনা বৃষ্টি পড়ছে
নীচে গাছের পাতার শিরায় ফোঁটাগুলো পড়েই লাফিয়ে উঠছে–
বছরের ভুলগুলো প্রকাশ করে দিতে।
আমি ভেবেছি এ হয়তো বসন্তকাল,
এটা ভেবেই আমার মনে হল আমি যেন
তোমার মাথার চুলে জড়াবার স্কার্ফের মতো হিম
দিতে চেয়ে অপেক্ষা করছি, যদিও এটা ছিল শীতকাল।
কিন্তু আমার নিজেকে মনে পড়ে,
আনন্দ আর বিষাদ মনে রাখতে চাই আমি,
আর যখন মাথার ওপর দিয়ে ঘুঘু উড়ে যেতে দেখি,
তখন বুঝি, তুমিই শরৎ।

মোঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাতারে ১৯৯১ সালে নাশিনের জন্ম। তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত। তাছাড়া ২০১০-এ ‘নতুন প্রজন্মের কবিতা’ সংগ্রহে তাঁর কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১২তেও কবিতাসংগ্রহে তাঁর কবিতা সংকলিত। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, ফিচার দৈনিক সংবাদপত্রে ও পত্রিকায় ছাপা হয়।

৫॥
বৃষ্টি
সাইনজারগেল নাশিন (১৯৯১-)

শুরু যে কী করে শেষের চেয়ে ভালো হয়
ভেবে মাথা গুলিয়ে যায় আমার।
সূক্ষ্ম, ভঙ্গুর, গাঢ় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো
অনেকক্ষণ আকাশ থেকে ঝ’রে
আনন্দ আর বিরক্তি পার হয়ে রোদ্দুর বয়ে আনে।
বৃত্তাকার ছন্দ কী করে ঘড়ির ঘণ্টায় কাঁটার ঘূর্ণনে
স্থানকে শুঁষে নেয়,
যখন মিনিটের কাঁটার সহজ নাড়ির স্পন্দন জড়ো করে।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনি মুহূর্তগুলোর সরে সরে যাওয়ার শব্দ
যখন সবচেয়ে জেল্লাদার স্ফটিকের ফোঁটাগুলো মাটিতে পড়ে
শক্ত মুঠোয় চিরকাল আমি
আমার যত বাসনা প্রাণপনে আঁকড়ে থাকবো।

মোঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবতারে ১৯৯১ সালে নাশিনের জন্ম। তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত। তাছাড়া ২০১০-এ ‘নতুন প্রজন্মের কবিতা’ সংগ্রহে তাঁর কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১২তেও কবিতাসংগ্রহে তাঁর কবিতা সংকলিত। তাঁর কবিতা, প্রবন্ধ, ফিচার দৈনিক সংবাদপত্রে ও পত্রিকায় ছাপা হয়।

৬॥
আবরণ
মিয়াগমার আমারহু

আমি বৃষ্টিতে হাঁটি জলের আবরণ নিয়ে।
যখনই সূর্য দেখা দেয়
আমার চারপাশে আলোর আবরণ।
ঠান্ডায় হাঁটি তুষারের আবরণে।
ঊর্ধ্বমুখি লাল মাটির ঘূর্ণিতে
আমি ধুলোর আবরণ নিই।
চার ঋতুর পরিবর্তনে
আমার আকাশের আবরণ।
কিন্তু একবার আমার পতন হলে
ঘাসের আবরণ হবে আমার।

মোঙ্গোলীয় কবি ও শিল্পী এম আমারহু শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে পড়ে উলানবাতারের ন্যাশনাল টিচার্স কলেজ থেকে
স্নাতক ও ১৯৯৯-এ মোঙ্গোলিয়ন কালচার অ্যান্ড আর্ট ইউনিভার্সিটি থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন
করেন। এ পর্যন্ত তাঁর এগারোটি কাব্যগ্রন্থ ও পঁচিশটি ছোটদের গল্পের বই প্রকাশিত। তাঁর রচনা মোঙ্গোলিয়ায়
অনেক সংকলনগ্রন্থে অবিশ শতকের ছ’টি মোঙ্গোলীয় কবিতা।