মৌমিতা
তরুণ লেখকদের মধ্যে অগ্রগণ্য নাম। প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি উপন্যাস। গল্প লেখেন নিয়মিত। সুবক্তা। ‘কুন্তল ফিরে এসো’ বইয়ের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য আকাদেমি যুব পুরস্কার। গত বছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’।
মাঝামাঝি
সারাজীবন মাঝখানে দাঁড়াতে চেয়েছে সুকোমল। কিন্তু কোনো দিন মাঝখানে দাঁড়াতে পারেনি, কোনো না কোনো একটা দলে ভিড়ে গেছে। সেই ছোটবেলায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলা দেখতে গিয়ে ভাবত, না ইস্টবেঙ্গল, না মোহনবাগান, মাঝামাঝি একটা অবস্থান নিয়ে থাকবে, যে ভালো খেলবে তাকে সাপোর্ট করবে। কিন্তু কি দুর্দশা !ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে বসে মোহনবাগানের কথা বলতে গেলে মার খেত, আবার মোহনবাগান গ্যালারিতে বসে ইস্টবেঙ্গলের কেউ ভালো খেলছে বললেও মার খেত। তার পর থেকে আর মুখে বলে না, কিন্তু মনে মনে সব সময় মাঝখানে থাকতে চায়। এই দলের এটা ভালো, ওই দলের ওটা ভালো, এইরকমভাবে বলতে চায়। রাজনীতিতে এই পার্টির এটা ভালো , ওই পার্টির ওটা ভালো, অভিনেতার এর এটা ভালো, ওর ওটা ভালো বলতে চায়। অভিনেত্রীর ক্ষেত্রেও তাই। এমনকি অঞ্চলেরও, হাওড়ার এটা ভালো , আবার কোলকাতার ওটা ভালো এভাবে বলতে চায়। কিন্তু এই করতে গিয়ে ওর দু’তরফের কাছেই খারাপ হওয়া ছাড়া আর কিছু হয় না। কিন্তু তবু নিজের স্বভাব পাল্টাতে পারে না সুকোমল। কোনও একটা দল হয়ে যেতে, কোনও একজনের পক্ষেই কথা বলতে ওর কীরকম একটা বিবেকে বাঁধে, মস্তিষ্কে আটকায়, গলা শুকিয়ে আসে ,জল তেষ্টা পায় বারবার।
একটু আধটু লেখালেখির শখ আছে সুকোমলের। ওর লেখা কবিতা ,গল্প-টল্প লিটিল ম্যাগাজিনে ছাপাও হয়। তেমন কিছু নাম করতে না পারলেও ভালো ভালো লেখাও কিছু বেরোয়। তো এই সব লেখালিখি করতে করতে সুকোমলের হঠাৎ করে মনে হল, তৃতীয় লিঙ্গ মানে রূপান্তরকামীদের নিয়ে একটা গল্প বা কবিতা লিখে ফেলে। সেই গল্পের সন্ধানে সে অমলের কাছে গেল। অমল আসলে অমল, কিন্তু মনে মনে আবার মলিনা। মানে অমল মলিনা হতে চায় কিন্তু মলিনা হতে পারেনি এখনও। নিজের সমস্ত জমানো টাকা পয়সা খরচ করে শারীরিকভাবে মলিনা হওয়ার চেষ্টা করছে। মানসিক ভাবে অনেকদিন আগে হয়ে গেছে। মলিনার সঙ্গে একদিন প্রিন্সেপ ঘাটে বেড়াতে গেল সুকোমল। অনেক কথা টথা শুনল, অনেক কিছু জানল তারপর মলিনাকে নিয়েই ফেঁদে ফেলল একটি কবিতা। যেখানে ওই মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে আছে মলিনা আর তার একদিকে মরুভূমি, অন্যদিকে সমুদ্র। এই প্রথম একটি দীর্ঘকবিতা ছাপা হল সুকোমলের। বেশ নামী একটা কাগজে। সুকোমল খুব খুশী। এতদিনে অন্তত তার মাঝখানে দাঁড়ানোর একটা স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। কিন্তু সেই স্বীকৃতির আনন্দ নিয়ে মলিনাকে ফোন করতেই মলিনার গলাটা যেন একটু অন্যরকম লাগল। মলিনা রাত্রিবেলা দেখা করতে বলল ওর সঙ্গে। কবিতা ছাপার আনন্দে উচ্ছ্বসিত সুকোমল মলিনাকে রেস্তোরাঁতে ট্রিট দেবার কথা জানাল। ঠিক সময়মতো রাত্রি সাড়ে সাতটায় মলিনা রেস্তোরাঁটার সামনে এসে দাঁড়াল । একটা পালাজো আর ওপরে একটা টপ পড়া ‘অমল’কে কীরকম যেন একটু কিম্ভূত লাগছে। এর চেয়ে শার্ট প্যান্ট পড়ে এলেই তো ভালো হত। এ আবার কী ড্রেস। আশেপাশের লোকজন দেখছে। তবু সুকোমল কিছু না বলে ওকে নিয়ে বসল, খাবারের অর্ডার দিল। খেতে খেতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে লাগল যে এতদিনে ওর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে। ওর কবিতা বড় জায়গায় বেরিয়েছে এবং সেই কবিতার ভেতরের যে দর্শন সেটা বলতে পেরেছে , একটা মানুষ কোনো একটা দলের না হয়ে গিয়ে, কোনো একটা দিক না নিয়ে, লাল বা সবুজ, ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগান কিছুই না হয়ে মাঝখানে থেকে বাঁচতে পারে, ঠিক যেমন অমল বেঁচে আছে। কিন্তু ওর কথার মধ্যেই খাওয়া যখন প্রায় শেষের দিকে, অমল বলল, ‘এই মাঝখানে থাকার ব্যাপারটা খুব একটা চলে না। জীবনের একটা জায়গা অবধি যায়, তার পরে আর জিনিসটা হয় না’। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল সুকোমল, কী বলতে চায় অমল? অমল সুকোমলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এর পরে আমার সঙ্গে তুমি আমার বাড়িতেও যেতে পারো’।
-বাড়িতে? কেন হঠাৎ ?
– না বলছিলাম আমি আর মাঝখানে দাঁড়িয়ে নেই। আমার অপারেশনের সব ডেট ঠিক হয়ে গেছে। আমি শিগগিরই মেয়ে হয়ে যাচ্ছি। মাঝখানে দাঁড়িয়ে জীবনের কোনো অর্থ হয় না। ছেলে বা মেয়ে একটা কিছু হতেই হবে।
-কিন্তু কেন অমল? ছেলে বা মেয়ে একটা কিছু হয়ে কী পাবে তুমি? এই মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই পৃথিবীর দুটো, পুরুষের শৌর্য , নারীর লাবন্য, এই দুটোকেই একই শরীরে ধারন করতে তোমার কী ভালো লাগছে না?
অমল একটা মুখ ঝামটা দিয়ে সুকোমলকে বলল, মোটেই না। আমি মেয়ে হতে চাই। আর মেয়ে হওয়ার পর বিয়ে করতে চাই তোমাকে। তুমি আবার না বলবে না তো?