বিদেশি কবিতা

অঁরি মিশো

March 13, 2019

16671

অঁরি মিশো

জন্ম ১৮৯৯

অঁরি মিশো (Henri Michaux)। জন্ম ১৮৯৯ সালে আর মৃত্যু ১৯৮৪ তে। জন্মেছিলেন বেলজিয়ামে কিন্তু জীবন কেটেছে ফ্রান্সে। লিখেছেনও ফরাসি ভাষায়। তিনি ছিলেন ভ্রমণ পিপাসু। প্রাচ্যের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি তাকে টানত। সেই টানে ত্রিশ দশকের গোড়ায় তিনি এসেছেন ভারতে। ছুঁয়ে গেছেন চীন ও জাপান। বৌদ্ধধর্ম আর প্রাচ্য লিপিবিদ্যায় তার ছিল অসীম আগ্ৰহ। যা ছাপ ফেলেছে তার অনেক লেখায়। সাহিত্যের উপর বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। লিখেছেন কবিতা এবং ট্রাভেলগ। “দ্য মেজর অরডিলস অফ দ্য মাইন্ড এন্ড দ্য কাউন্টলেস মাইনর ওয়ান্স”, “মিজারেবল মিরাকেল” ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য বই-এর অন্যতম। তবে এটা ঘটনা তিনি সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছেন প্ল্যুম সিরিজের লেখাগুলোর জন্য। অদ্ভুত এক শান্তিপ্রিয় চরিত্র প্ল্যুম। প্ল্যুম সিরিজের লেখাগুলো তাকে অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা এনে দেয়।

ভাষান্তর ।। অরুণাভ ভৌমিক

ভ্রমণ বিষয়ক গল্প

বেড়াতে গিয়ে প্ল্যুমের সঙ্গে সবারই যে সবকিছু নিয়মমাফিক হয়, এমন কথা প্ল্যুম জোর গলায় বলতে পারে না। কেউ তার পা মাড়িয়ে দেয়। কেউ তার কোটে হাত মোছে। এতে প্ল্যুম কিছু মনে করে না। সে নির্বিকার বিনয়াবনত হয়ে বেড়াতে ভালবাসে। আর ভাবে এভাবেই যতদিন সম্ভব চলুক না। কেউ যদি মেজাজ দেখিয়ে শেকড়, একটা আস্ত মস্ত শেকড়, তার প্লেটো দিয়ে বলে, “নাও হে, হাঁ করে বসে না থেকে খেয়ে নাও।” ” বটেই তো, বটেই তো। এই তো খাচ্ছি।” সোনা মুখ করে খেয়ে নেয় প্ল্যুম। সে গোলমাল ভালবাসে না। রাত্তিরে শুতে না দিয়ে কেউ যদি বলে, ” তুমি তো বেড়াতে এসেছ – ঘুমোবার জন্য কেউ এতদূর আসে না। যাও জিনিস পত্তর গুছিয়ে নাও। এখন তো হাঁটবার সময়।” “বটেই তো, বটেই তো। এই একটু মজা করছিলাম আর কি! মানে ঠাট্টা।” সে গভীর রাত্রিতে বেড়িয়ে যায়। ট্রেনে উঠলে কেউ যদি বলে,” ব্যাপারটা কি তোমার? এই যে গরম করেছি ইঞ্জিনটাকে, সেকি তোমার মত এক তাগড়াই জোয়ানকে বয়ে নেবার জন্যে? যে এখানেই কাজে লাগতে পারে , কোথাও যাবার দরকার নেই যার, ভেবেছ তার জন্যেই সুড়ঙ্গ খুঁড়েছি, ডিনামাইটে উড়িয়েছি পাহাড়, মাইলের পর মাইল রেল লাইন পেতেছি ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে? আর শুধু কি তাই – সবসময় সতর্ক থাক কখন স্যাবোটেজ হয়! আর তুমি ভাবছ সবকিছু কিনা….” “ঠিকই তো, ঠিকই তো! একটু দেখার জন্য উঠেছিলাম আর কি। স্রেফ কৌতুহল। আর কিছু নয়।” বলে জিনিষপত্তর নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় সে। হয়তো রোমে গিয়ে কলিজিয়াম দেখার শখ হয়। গিয়ে শোনে, ” না হে, তা হয় না। হয়তো তোমার ইচ্ছে হল একটু হাত দিয়ে ছুঁই, কিংবা ঠেস দিয়ে দাঁড়াই, এমনকি বসতেও চাইতে পার। এই করেই তো এখন অবশিষ্ট শুধু ধ্বংসাবশেষ। স্রেফ ধ্বংসাবশেষ। অনেক শিক্ষা হয়েছে আমাদের। কঠিন শিক্ষা। আর নয়!” ” নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, মানে আমি ঠিক ঢুকতে চাই নি। এই একটা পিকচার পোস্টকার্ড কিংবা ছবি… যদি সম্ভব হয়…” এবং আর কিছু না দেখেই শহর ছেড়ে চলে যায় সে। এরপর একটা স্টিমারে চড়তেই জাহাজের মাইনে দেওয়ার লোকটা হাত দিয়ে ওকে দেখিয়ে বলে, ” দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছে ও ওখানে! কয়লাঘরে পাঠিয়ে দাও। ডিসিপ্লিন আর রইল না। এদিকে দ্বিতীয় ঘন্টি তো পড়ল।” সারাটা পথ কয়লাঘরে হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে প্ল্যুম। কিন্তু কোন কথা বলে না। না প্রতিবাদ। না নালিশ। শুধু সেই দুর্ভাগাদের কথা ভাবে। যারা কোথাও যেতে পায় না। আর সে তো ঘুরে বেড়ায়। সব সময় বেড়াচ্ছে। কি সৌভাগ্যবান সে।

একজন শান্তিপ্রিয় মানুষের গল্প

ঘুম চোখে খাট থেকে হাত বাড়িয়ে দেয়াল না ছুঁতে পেরে প্ল্যুম অবাক হয়ে গেল। সে কি! দেয়ালটা গেল কোথায়? শেষে ভাবল, হুঁ, নিশ্চয়ই পিঁপড়েরা খেয়ে ফেলেছে। এবং যথারীতি আবার ঘুমিয়ে পড়ল। কিছু পরে তার স্ত্রী এসে তাকে ঠেলে তুলল, ” বেহদ্দ কুঁড়ে! একটু চোখ মেলে দেখ। বেশ তো ঘুমিয়ে আছ আর সেই ফাঁকে যে কে এসে আমাদের বাড়িটা চুরি করে নিয়ে গেছে।” প্ল্যুম তাকালো। আরে সত্যিই তো! ওদের চারিদিকে শুধু আকাশ আর আকাশ। সীমাহীন আকাশ। ” তা নিয়েই যখন গেছে…” সে ঘুমোলো। কিছুক্ষণ পরে একটা শব্দ প্ল্যুমের কানে এল। একটা ট্রেন প্রচন্ড গতিতে তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। ” যে রকম বেগে ওটা আসছে, তাতে পালাবার মানে হয় না, তার আগেই আমাদের উপরে…” ভেবে সে আবার ঘুমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর ঠান্ডায় তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখে, সারা শরীর রক্তে ভেজা। পাশে পড়ে আছে তার স্ত্রীর খন্ড বিখন্ড দেহটা। সে ভাবলো, ” রক্তের সঙ্গে বিশ্রী ব্যাপার গুলো প্রায়ই অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে থাকে। ট্রেনটা না গেলেই আমি খুশি হ’তাম। কিন্তু ব্যাপারটা যখন ঘটেই গেছে…” ভেবে ঘুমিয়ে পড়ল সে। “এখন” বিচারক বললেন ” তোমার স্ত্রী নিহত হলেন, শুধু তাই নয়, আট খন্ডে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন আর পাশে শুয়ে থেকে তুমি বাধা দেবার চেষ্টাই করলে না। এমন কি খেয়ালই করলে না। তুমি এর কি কারণ দেখাবে? এটাই মূল রহস্য। কেননা ব্যাপারটা পুরোপুরি এর ওপরেই নির্ভর করছে।” ” ঘটনা তো ঘটেই গেছে।” প্ল্যুম ভাবল, ” এখন তো আর তাকে সাহায্য করা সম্ভব নয়।” এবং আবার ঘুমিয়ে পড়ল সে। ” আগামীকাল তোমার ফাঁসি হবে। আসামী, কিছু বলার আছে?” ” মাফ করবেন। আমি গোড়া থেকেই আপনার কথা শুনিনি।” সে বলল এবং নিয়মমাফিক ঘুমের মধ্যে ফিরে গেল।

সরলতা

এতদিন আমার জীবনেএকটা জিনিষেরই অভাব ছিলসরলতা, সেটা হল সরলতা।ইদানীং কিন্তু আমি একটু একটু করে পাল্টাচ্ছিএই যেমন, এখন আমি বাইরে গেলেসঙ্গে নিয়ে যাই বিছানাপত্রযে মেয়েকে ভালো লাগেতার সঙ্গেই বিছানায় যাইমেয়েটির নাক বা কান খুব বিচ্ছিরি দেখতে হলেবা বড় বড় হলেসেগুলো খুলে নিয়ে বিছানার তলায় রেখে দেইযাতে সে চলে যাবার সময় সেগুলো আবারনিয়ে যেতে পারেআমি রাখি শুধু সেটাইযেটা আমার খুব পছন্দের।যদি সে অন্তর্বাস পাল্টাতে চায়তো আমি সেগুলো পাল্টে দেইনা, না এ আর কিছু নয়এ আমার উপহার।কিন্তু তক্ষুনি যদি চোখে পড়ে আরো সুন্দরী নারীআমি ক্ষমা চেয়ে নেই প্রথমাটির কাছেতারপর তাকে অদৃশ্য করে দেই।কিন্তু যে সব লোকজনেরা আমাকে চেনে জানেতারা ভাবে আমি যা সব বললাম এতক্ষণতা কখনোই করতে পারব নাকারণ আমার স্বভাবই সেরকম নয়! আমিও একসময় নিজের সম্বন্ধেএরকমই ভাবতাম!তারও একটা কারণ আছেসেটা হল আমি তখন যাই ইচ্ছে করতযাই পছন্দ হোতসেটাই করতাম না। ইদানীং আমার বিকেলবেলা গুলোযে কি অসাধারণ কাটছে!(সকালের দিকে যে এখন কত ব্যস্ত থাকি!)

রাণীমহল

রাজপ্রাসাদে পরিচয়পত্র নিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেরাণী প্ল্যুমকে বললেন, ভীষণ ব্যস্ত রাজামশাই এখন।তবে চাইলে আজ বিকেল পাঁচটায় আমরা দু’জনেতার সাথে দেখা করতে পারি। তিনি খুশি হবেন খুবডেনদের প্রতি তার যে অসীম দুর্বলতা।চল, ততক্ষণ আমরা এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করি।কত যে বড় প্রাসাদ, ভয়ে ভয়ে থাকিকখন না জানি পথ হারিয়ে ফেলে নিজেকেআবিষ্কার করব রান্নাঘরে। বুঝতেই পারছেন একজন রাণীর পক্ষে সেটাকিরকম একটা হাস্যকর ব্যাপার হবে।বরং এদিকে চলুন। এদিকটা ভালো চিনি।এদিকেই যে আমার শয়নকক্ষ। ধীরে ধীরে দু’জনে ঢুকল রাণীর শোবার ঘরে ইচ্ছে করলে কিছু একটা পড়ে শোনাতে পারেনআমাদের হাতে তো এখনও দু’ ঘন্টা সময়কিংবা খেলা যেতে পারে তাস তবে হ্যাঁখেলা শুরুর আগেই নির্দ্বিধায় স্বীকার করছিআমি খেলি এবং হারি ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি। কেমনক্লান্তিকর না ব্যাপারটা! আর বসে থাকাওআমার ধাতে নেই, ইচ্ছে করলেই এই ডিভানটারউপর আমরা শুয়ে থাকতে পারি অতএব তারা শুয়ে পড়ল কি যে হোল, রাণী হঠাৎ উঠে বসলেনএই ঘরটা এত গরম যেন সবসময়ইএখানে গ্ৰীষ্মকাল। তা আপনি কি আমাকেএকটু সাহায্য করবেন পোশাক খুলতে – ভারীখুশি হতাম তবে! গল্প শুনতে কি যে আরাম হোত তাহলে! ডেনমার্ক নিয়ে শুনতে কি যেউদগ্ৰীব হয়ে আছি আর হ্যাঁ, আমার এই জামাটা খোলাকিন্তু খুবই সোজাএই যে দুই হাত উপরে তুললামএখন যে কেউ সে যদি বাচ্চাও হয়কেমন সুন্দর জামাটা টেনে খুলে দিতে পারবে কিন্তু একটা বাচ্চাকে তো আমি তাকরতে দিতে পারি নাএটা ঠিক আমি তাদের পছন্দ করিকিন্তু ওরা তো সব কিছুই কেমন সহজেনষ্ট করে ফেলে প্ল্যুম রাণীকে নগ্ন করে দিল আরে, তুমি কি এভাবেই চুপচাপশুয়ে থাকবে নাকি? শোবার ঘরেজামাকাপড় পড়ে অন্য কারও থাকাটাযে কি ভীষণ অস্বস্তিকর লাগে তা জানেএকমাত্র বিবাহিতরাইরাণী শান্ত ধীর গলায় আরও বললেন, মনে হচ্ছেতুমি যেন আমাকে ছেড়ে দূরে কোথাওচলে যাচ্ছ আর আমি যেন একা একাপড়ে আছি কোন এক মরুভূমিতে অতএব প্ল্যুমও সব খুলে নগ্ন হোল এবংনিজের শার্টের উপরেই শুয়ে পড়ল এখন বাজে কেবল তিনটা আর ডেনমার্ক নিয়েগল্প করে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত কাটানোর মতগল্প নিশ্চয়ই তোমার নেই আর সত্যি কথাবলতে কি আমারও আর শোনার অত ইচ্ছে নেই তুমি বরং এক কাজ কর, এমন একটা কিছু করযা আমাদের একরাশ আনন্দ দেবেআর হ্যাঁ, তোমাকে একটা জিনিষ দেখাই যাআমার ইদানীং খুব রহস্যময় লাগছেদেখি, একজন ভদ্র, সভ্য উৎসাহী ডেনএব্যাপারে কতটা কি জানে এই যে দেখো – আমার ডান স্তনের ঠিকনীচে ছোট ছোট কিছু দাগ, দু’টো ছোটআর কালো আর বড়টা দেখঠিক যেন কালশিটে বড়টা দেখ, ভাল করে দেখ -কি কুৎসিত! কি অদ্ভুত! তাই না?আর বাঁদিকের স্তনটা দেখ, একেবারেই গড়পড়তা, সাধারণ, ডানের সঙ্গে কোনমিলই নেই। কি সাদা – তাই না? ধর, একটু ভালো করে ধরে পরীক্ষা করমন দিয়ে- সময় তো আর কম নেইআমাদের হাতে! ওই সব তত্ত্ব নিয়ে মাথাঘামানোর চেয়ে এটা কত বেশি আকর্ষণীয়কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্ল্যুম সঙ্কোচ বোধ করল। তবু সঙ্কোচ নিয়েইসে রাণীর স্তনে হাত দিল পরীক্ষা করার জন্যতার অনভিজ্ঞ আঙ্গুল ছুঁয়ে গেলরাণীর অলৌকিক স্তন আর চিহ্নগুলোতার হাত কেঁপে উঠল। প্ল্যুম ভাবতে শুরু করল ব্যাপারটা নিয়ে কি ভাবতে শুরু করেছ? তুমিও দেখছি পাকাখেলোয়াড়। ভাবছ আরও কেউ আছে নাকি আমার!না রে বাবা, নেই – লাজে রাঙা রাণীফিসফিস করে উঠলেন,বল, এইবার তুমি ডেনমার্ক নিয়ে বলআর শোনো, একটু ভালো করে চেপে বসতআমার উপর যেন তোমার কথা শুনতেআমার অসুবিধে না হয় অস্বস্তি হচ্ছিল প্ল্যুমের। কিন্তু আর সেনিজের উত্তেজিত অবস্থাটালুকিয়ে রাখতে পারল না ….. রাণীর পাশেসে শুয়ে পড়ল।রাণী হাসলেন, প্ল্যুম, তোমার যা অবস্থা দেখছিতাতে ডেনমার্ক নিয়ে আলোচনাপরে করলেও হবে – কি বল? প্ল্যুম, আদর কর, তাড়াতাড়ি আদর করতেশুরু কর প্রিয়, আদর কর আমার পায়ে আর জিভে, নইলে হয়তো ভুলেই যাবে কেনআমরা এভাবে পাশাপাশি শুয়ে আছিতোমারও নিশ্চয়ই সেটা ভালো লাগবে না… ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরে এসে ঢুকলেন রাজা স্বয়ং!